রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩২ অপরাহ্ন
মোহাঃ মণিরুজ্জামান মাসুদ, কুমারখালী: দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তালমিলিয়ে বেড়ে যাওয়া আমিষসহ পুষ্টিচাহিদা মেটাতে যখন বাইরে থেকে আমদানি করা বিভিন্ন প্রজাতির মুরগী আবাদ ব্যাপকভাবে প্রবাহমান হচ্ছে তখন সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে হাজল পদ্ধতিতে দেশী জাতের মুরগীর ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন ও পালন করে এখন স্বাবলম্বী কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নস্থ ৬গ্রামের অন্ততঃ ৩হাজার নারী। তাঁদের পরিবারের জন্য আমিষসহ পুষ্টিচাহিদা মিটিয়ে এখানকার উৎপাদিত ১হাজার ২৬টন দেশীয় মুরগী ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের পাইকারী বাজারগুলোতে যাচ্ছে প্রতি বছরেই। আর তা থেকে আয় হয় ১কোটি ৭১লাখ টাকা। গৃহস্থালীর পাশাপাশি এখানকার প্রতিটি নারী প্রতিমাসে আয় করছেন ৫থেকে ৬হাজার টাকা।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা, কাঞ্চনপুর, শ্যামপুর, পাইকপাড়া, ইচ্ছাখালী ও শিংদহ নিয়ে গঠিত উপজেলা কৃষি-সম্প্রসারণ সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাঁওতা ব্লক। এখানে দ্বায়িত্বরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বকুল হোসেন নিজ গবেষণালব্ধ চিন্তা-চেতনায় এই এলাকার ২হাজার ৮শত ৫০টি কৃষক পরিবারের অন্ততঃ ৩হাজার মহিলাকে নিয়ে গড়ে তোলেন ছয়টি কৃষি পাঠাগার। তাঁদেরকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হাজল পদ্ধতিতে দেশী জাতের মুরগীর ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা তৈরী ও লালন-পালনে উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান তৈরী এবং খাবার ব্যবস্থাপনায় উপযুক্তরুপে গড়ে তোলেন তিনি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের প্রত্যেকের বসতবাড়ির উঠানে একটি করে মুরগীর (তিনতলা) ঘর ও বসবাসরত ঘরের মধ্যে ডিম ফোটানোর জন্য একটি-দুটি করে হাজল তৈরী করা হয়। যেখানে প্রতিমাসে প্রত্যেকটি বাড়িতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই বাচ্চা উৎপাদন করা হচ্ছে। সেগুলো লালন-পালনের মধ্যদিয়ে ২হাজার ৮শত ৫০টি বাড়িতে প্রতিবছরে গড়ে উৎপাদন করা হচ্ছে ১হাজার ২৬টন দেশী জাতের মুরগী। স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীরা এলাকাথেকে মুরগীগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যান রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে। বিক্রি করে প্রতিবছরে আয় করছেন অন্ততঃ দুই কোটি টাকা।
এ ছাড়াও জৈব নাইট্রোজেন সার এবং জৈব বালাইনাশক তৈরী অতঃপর ব্যবহার করে নিরাপদ ফল ও শাক-সব্জি উৎপাদন, সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্ট (আইএফএমসি) প্রকল্পের প্রযুক্তিতে মৎসচাষ-সম্প্রসারণ, ছাগলপালন, ইউএমএস পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ, খামারজাত সার তৈরী, ফলগাছ ব্যবস্থাপনা ও খামারের উপাদানের উপজাতের ব্যবহারসহ নানাবিধ কার্যক্রমে এখানকার নারীদের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করছেন পুরুষেরাও।
হাজল তৈরী ঃ
কাদামাটি, পাটের আঁশ, বিচালি-চূর্ণ একত্রে ভালোভাবে মিশিয়ে ৭ইঞ্চি গভীর, ২-৩ইঞ্চি পুরু এবং ১৩-১৪ইঞ্চি গোলাকার ব্যাসার্ধ পরিমাপের হাজল তৈরী করার পর রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হয়।
হাজল পদ্ধতি ঃ
হাজলে মুরগী বসানোর আগে এক থেকে দুই ফোটা কেরোশিন তেলের সাথে পরিমাণমত ছাই মিশিয়ে মুরগীকে ধূলিগোসল করানো হয়। যাতে কুচে মুরগীকে ঊকুন জাতীয় কোনপ্রকার ক্ষতিকর পোকা আক্রমণ করতে না পারে। এরপর মুরগীর ওজনের অর্ধেক ওজনসম্মত পরিমানের সম-আকৃতির ডিম নির্বাচন করতে হবে এবং কুচে মুরগী হাজলে বসানোর ২১দিন পর বাচ্চা ফুটে বের হবে। ১২-১৪ দিন পর মা মুরগিকে বাচ্চা থেকে আলাদা করতে হবে। এই প্রযুক্তিতে একটি দেশীয় মুরগী বছরে ৬ বার ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন করে থাকে।
বৈশিষ্ট্যগত উপকারিতা ঃ
হাজলে প্রয়োজনমত খাবার ও পানির ব্যবস্থা থাকায় মুরগী হাজল থেকে সহজে বের না হওয়ার কারণে ডিম পূর্ণাঙ্গরুপে তাপ পায়। ফলে দ্রুত ডিম ফোটে এবং হাজল ভারী বলে ডিম ভাঙার সম্ভাবনা থাকেনা। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এ পদ্ধতিতে বাচ্চা উৎপাদন করলে স্বাস্থ্যহানি না ঘটায় মুরগী অল্প দিনের মধ্যেই ডিম দিতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক চন্ডিদাশ কুন্ডু বললেন, মুরগী পালনে পশুসম্পদ অধিদপ্তরের কাজ করার কথা থাকলেও দেশের উন্নয়ণকল্পে আমাদের বকুল হোসেনের কর্মকান্ড শুধু যশোর অঞ্চল নয়, গোটা দেশেই নজীরবিহীন। মাংশের চাহিদা পূরণে দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মুরগীর বাচ্চা আমদানি করা হচ্ছে আমাদের দেশে। সেগুলো পালনের মধ্যদিয়ে মাংসলরুপে আবাদ করতে রাসায়নিকসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানোর কারণে দেখা দেয় জটিল রোগ-ব্যাধি। এতদসত্বেও এ আবাদি প্রভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের দেশে। তাই কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সাঁওতা ব্লকের নারীদের এ কর্মকান্ডকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই আমি কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের উপ-পরিচালককে তাঁদের সবগুলি উপজেলার কৃষক পরিবারের নারীদেরকে নিয়ে এখানে পরিদর্শনের ব্যবস্থা নিতে বলেছি। এভাবে সমগ্র বাংলাদেশের নারীদেরকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই বাইরে থেকে মুরগীর আমদানি নির্ভরতা থেকে উঠে আসা যাবে সহজেই। রোগ-ব্যাধির হাতথেকে রক্ষাপাবো আমরা, দেশের অর্থণীতিও হবে সমৃদ্ধ।
উপজেলার শিংদহ গ্রামের ফাতেমা, রোজিনা, আমেনা, জান্নাতুল ও সাহেলা খাতুনসহ স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধাবা নারীরা বললেন, প্রতি ১মাস অন্তর এখানকার কিছু ব্যবসায়ীরা আমাদের বাড়িতে এসে মুরগী কিনে নিয়ে যান। সংসারে উপার্জনক্ষম তেমন কেউ না থাকলেও এ কাজ করে আমাদের সন্তানাদি নিয়ে সংসার চলে যায় ভালোভাবেই। খাওয়া পড়ার পাশাপাশি মুরগী ও ডিম বিক্রি করে ২-৪টা ছাগল, ১-৩টা গরু কিনেছি। আয়-রোজগারের এ উৎস থেকেই আমরা ইউএমএস পদ্ধতিতে গরুগুলোকে মোটাতাজাকরণ এবং সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্ট (আইএফএমসি) প্রকল্পের প্রযুক্তিতে মৎসচাষ-সম্প্রসারণের কাজও ইতোমধ্যেই শুরু করেছি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখানকার ৬ গ্রামথেকে মুরগী সংগ্রহ করে আমরা মাসে একবার ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে নিয়ে যায়। কৃষিকাজের পাশাপাশি এ ব্যবসা করে আমরা বেশ ভালোভাবেই জীবণ-যাপন করছি।